আষাঢ় গগনে

দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

আষাঢ় গগনে আজ
ভাসে মেঘদূত রাজ

আকাশে ঘনায় আঁধার,
পড়ে জল ঝিমঝিম ,
রিমঝিম জুঁই ঝরে

নেই ওই নিঠুর খরা,
ঝরে পড়ে অবিরাম ধারা
হয়েছে হৃদয় তৃপ্তিভরা,
মেঘেরা পেয়েছে ছাড়া

আবার আকাশে ঘনায় কালো,
উতল হল মন ,
সূর্য্য কোথা লুকালো

বহে ওই বহ্নি সমীরণ ,
ঝরে আজ মাটিতে বকুল,
হৃদয় হল আকুল

বর্ষায় কুহরিত হল ধ্বনি
ওড়ে ওই যত শালিখ ,
ডাকে বাগে ওই কোকিল,
মাতল সে আনন্দে , আনন্দে

৯ এপ্রিল ২০০৮

আজ পহেলা আষাঢ়

আজি আষাঢ়ে-
গাছে ফুটেছে কদম ফুল
ময়ুর মেলেছে পেখম
রিমঝিম বুষ্টিতে
চারিধার অথৈ থৈ থৈ

আজি আষাঢ়ে-
সবুজের প্রান্তরে রুপ-রঙের
লাগিয়াছে মেলা

আজি আষাঢ়ে-
মন আমার ঝর ঝর বাজে...........

"আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,
আসে বৃস্টির সুবাস বাতাস বেয়ে
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নুতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে..."


আষাঢ়

নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।

ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন, ধবলীরে আনো গোহালে
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি
মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি,
রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।।

শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে
পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,
দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ,
দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি রে
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।।

ওগো, আজ তোরা যাস নে গো, তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে
ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল,
ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল,
ওই বেণুবন দুলে ঘনঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।

- কবিগুরু, শিলাইদহ
২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৭


আজ আষাঢ়ের প্রথম দিনঝর ঝর করে অঝোরে ঝরে বর্ষা এলো

বর্ষার এক পশলা বৃস্টিকে জানালায় হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে করতে অথবা টিনের চালে অনবরত বর্ষণের গুঞ্জনে কান পেতে ছন্দ খুঁজতে খুঁজতে জীবন ও প্রকৃতি মিশে যায় চলমান সময়ের হাত ধরেবর্ষা আনে সবুজআনে প্রাণআনে ফসলআনে ধ্বংসআনে তান্ডবতারপর একসময়ের বর্ষায় থমকে যাওয়া মানুষগুলোর প্লাবিত জীবনধারা আবারও ঘুরে দাঁড়ায় নতুন সৃস্টির প্রতিজ্ঞায়আবার নতুন করে গড়ে উঠে জনপদবর্ষা আমাদের মানুষগুলোকে বেপরোয়া করে তোলে, তাদের জীবন সংগ্রামে যোগ করে সৃস্টিশীলতা, নিয়ে আসে নতুন প্রাণের উদ্দীপনা এভাবেই চলছে চিরায়ত বাংলার বর্ষাবরণপ্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলে আমাদের জীবনএখানেই আনন্দ, এখানে সাফল্যবর্ষাকে দু' হাত বাড়িয়ে বরণ করতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্ঠে বেজে উঠে:

"আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,
আসে বৃস্টির সুবাস বাতাস বেয়ে
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নুতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে..."

১৮৫২ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার নবাগত জনসমষ্টির স্থান সংকুলানের জন্য ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে জমি কিনতে চেয়ে চিঠি দেন। উত্তরে সর্দার সিয়াটল যে চিঠি লিখেছিলেন তা নিচে দেয়া হলো-

" ওয়াশিংটন থেকে প্রেসিডেন্ট সাহেব জানিয়েছেন যে তিনি আমাদের জমিজিরাত কিনতে চান। কিন্তু আকাশ কি কেনাবেচা করা যায়? যায় জমি কেনাবেচা করা? আমাদের কাছে এই ধারনা খুব অদ্ভূত মনে হচ্ছে। বাতাসের সজীবতা, জলের স্বচ্ছতা তো আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। তাহলে? কী করে কিনবেন তাদের?

" এই ধরিত্রীর ধূলিকনা আমার লোকদের কাছে পবিত্র। প্রতিটি পাইন গাছের পাতা, প্রতিটি বালুকণা, ঘনান্ধকার অরণ্যের প্রতিটি শিশিরকণা, প্রতিটি মাঠ, প্রতিটি গুন্জরিত পতঙ্গ। আমার লোকেদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায় এরা সবাই খুব পবিত্র।

" গাছ রস টেনে নেয় গোপন পথে-আমরা তা জানি, যেমন জানি রক্ত আমাদের ধমনী বেয়ে চলে। আমরা এই ভূলোকের অংশ যেমন এই ভূলোক আমাদের অংশ। সুরভিত ফুলেরা আমাদের বোন। ভালুক, হরিণ, রাজকীয় ঈগল-এরা সবাই আমাদের সহোদর ভাই। পাহাড়ের চূড়া, সবুজ প্রান্তরের রস, ঘোড়ার শরীরের ওম, আর মানুষ সবাই আমরা একই পরিবারের সদস্য।

" ঝরণায়, নদীতে স্ফটিক-স্কচ্ছ যে জল গড়িয়ে যায় সে তো নেহায়েত জল নয়, আমাদের প্রপিতাদের দেহের স্বেদ, রক্ত। আমরা যদি আপনাকে জমি বিক্রি করি তো অবশ্যই স্মরণ রাখবেন যে জমিটা পবিত্র। ঝিলের স্বচ্ছ জলে অলৌকিক ছায়া পড়ে। তার প্রতিটিতে আমাদের লোকদের জীবনের স্মৃতি আর ঘটনা বিম্বিত হয়। বনের মর্মরধ্বনিতে আমি আমার পিতামহের ডাক শুনতে পাই।

" নদীরা আমাদের ভাই। তাদের জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটে। ওরা আমাদের নৌকা বয়ে নেয়, আমাদের সন্তানদের মুখের গ্রাস জোগায়। অতএব, আপনি অবশ্যই নদীকে সেই রকম দয়াদাক্ষিণ্য করবেন যেমনটি করবেন আপনার ভাইকে।

" আমরা যদি জমি বিক্রি করি তো মনে রাখবেন যে সেই জমির ওপর প্রবাহিত বাতাস আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। হাওয়া তার উদ্যমের অংশ দান করে তার সমস্ত পোষাকে। হাওয়া যেমন প্রথম ফুৎকারে আমাদের প্রপিতামহদের ফুসফুসে দিয়েছে দম, তেমনি গ্রহন করেছে তার অন্তিম শ্বাসবায়ুও। আমাদের শিশুদেরও বাতাস দেয় জীবনের উদ্যম। অতএব আপনাকে জমি বিক্রি করলে আপনি অবশ্যই সেই জমি বিশেষ যত্ন করে রাখবেন যেন সেখানে লোকে মাঠের ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ পাওয়ার লোভে সমবেত হয়।

" আমাদের সন্ততিদের আমরা যা শিখিয়েছি, আপনারাও কি আপনাদের সন্ততিদের তা-ই শেখাবেন? আমরা শিখিয়েছি এই ধরনী আমাদের মা। এই ধরনীর কিছু হলে এর সন্তানদের সবার তা হবে।

" আমরা এটুকু জানি: মাটি মানুষের নয়, বরং মানুষই মাটির। রক্ত যেমন আমাদের একত্রে বেঁধেছে, তেমনি সমস্ত জিনিসও পরস্পরে বাঁধা। জীবনের জাল মানুষ বয়ন করেনি। সেতো জালে কেবল বাঁধা। এই জালের ক্ষতি মানে তার নিজেই ক্ষতি।

" আপনাদের ভবিষ্যৎ আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়। গরু-ঘোড়া সব জবাই করলে কি হবে অবস্থাটা? বুনো ঘোড়া ফোষ মানিয়ে চালাবেন? অরণ্যের গোপন জায়গাগুলো যখন মানুষের ঘামের গন্ধে উঠবে ভরে, এবং উচুঁ পাহাড়ের চুড়া আলাপি তারের আড়ালে পড়বে ঢাকা, তখন কি হবে? ঝোপঝাড়, বন বাদাড় যাবে কোথায়? উধাও উধাও। আর ক্ষিপ্রগতি টাট্ট্ুঘোড়া আর শিকারকে অকালে বিদায় জানাতে হলে কেমন হয় ব্যাপারটা? তখন ফুটে উঠবে জীবনের অন্তিম দশা এবং শুরু হবে ধুঁকে ধুঁকে জীবন পথে চলা।

" যখন একেবারে শেষ মানুষটিও তার নিধুয়া দিগন্তে পাড়ে হাওয়া হয়ে গেছে, এবং তার স্মৃতি কেবল ভাসমান মেঘের মতো প্রেইরির পাথারে থেকে থেকে ছায়াসম্পাত করে বেড়াচ্ছে, তখনো কি এই সমুদ্রতট, এই অরণ্যরাজি থাকবে, যেমন আজো আছে? তখনো কি আমার লোকেদের আত্না মিশে থাকবে এদের আনাচে কানাচে?

" নবজাতক যেমন তার মায়ের হ্দস্পন্দন ভালোবাসে, তেমনি আমরা ভালোবাসি এই পৃথিবীটাকে। অতএব আমরা জমি বিক্রি করলে আপনিও একে আমাদের মতোই ভালোবাসবেন। আমরা এর যেমন যত্ন নিয়েছি, আপনাকেও সে রকম যত্ন নিতে বলি। জমি সম্প্রাদনের অবিকল স্মৃতি মনে ধরে রাখুন। সমস্ত সন্তানের জন্য জমি রক্ষা করুন, জমিকে ভালোবাসুন যেমন ঈশ্বর আমাদের ভালোবাসেন।

" আমরা যেহেতু সবাই ভূমির অংশ, সে জন্য আপনিও এর অংশ। জমি আমাদের কাছে মূল্যবান, তেমনি আপনার কাছেও। একটা বিষয়ে আমরা নিশ্চিত: ঈশ্বর এক। মানুষ-সে লালই হোক আর সাদাই হোক, কখনো সে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না; হাজার হলেও আমরা তো পরস্পর ভাই।

উৎস:
জোসেফ ক্যাম্পবেলের মিথচিন্তা
ভাষান্তর: খালিকুজ্জামান ইলিয়াস

মূল পোস্ট