বাংলাদেশের ভূভাগঃ বঙ্গদেশ, বাঙালি জাতি ও বাঙলা ভাষার মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকলে উদ্ভব ও বিকাশের ধারা একছিল না। বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাঙলা এ তিন শব্দের মধ্যে প্রাচীণ হল বাংলাদেশের ভূভাগ। বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর বয়স ৫০০ কোটি বছর। ক্রমে ক্রমে অগ্নিকুন্ড থেকে শীতল হওয়ার ধারায় বিশ্বের ভূপৃষ্ট সর্বপ্রথম কঠিন শিলায় পরিণত হয়। উতপ্ত অবস্থা থেকে শীতলীকরণের প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্টের শিলাগুলো খন্ড খন্ড হয়ে তরল ভূভাগের উপরে ছিল ভাসমান ও বিচরণশীল। তেমনি বিচরণশীল একটি খন্ড বা প্লেটের নাম ভারতীয় প্লেট। এটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার কাছাকাছি। প্রায় ২০ কোটি বছর আগে ভারতিয় প্লেট উত্তরদিকে মন্থর যাত্রা শুরু করে। ৮ কোটি বছর আগে এর গতি প্রতি শতাব্দীতে ৯ মিটার থাকলেও ৫ কোটি বছর আগে এর গতি হ্রাস পেতে থাকে। ভারতিয় প্লেটের অয়তন আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমানে ভারতিয এ প্লেট উত্তর-পূর্বদিকে বার্ষিক ৫সেন্টিমিটার করে সঞ্চরণশীল। যাহোক ভারতিয় প্লেটের এই পরিক্রমায় এখন যেখানে উপমহাদেশ, সেখানে অবস্থিত টেথিস সমুদ্র লুপ্ত হযে যায় এবং ভারতিয় প্লেট অনবরত ধাক্কা খেতে থাকে ইউরেশিয় প্লেটের সাথে, যার কারণে উপরিভাগের নরম মাটি ভাঁজ হয়ে সৃষ্টি হয হিমালয়সহ অন্যান্য পর্বতমালার । সিলেটের পাহাড় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় পর্বত এ প্রক্রিয়ায় টারসিয়ারি অধিযুগে সৃষ্ট। এ হিসাবে সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকার সৃষ্টি কোটি বছর আগে। পরবর্তী সময়ে প্লাইস্টোসিন যুগে (১০ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ বছর আগে) সৃষ্ট হয় বরেন্দ্র, মধুপুর ও লালমাই অঞ্চল ( ^ সুত্র ১),। বাংলাদেশের বাদ বাকী জায়গা গঠিত হয়েছে সাম্প্রতিককালে। এক গবেষণায় জানা যায যে যশোর ও ফরিদপুর গঠিত হয়েছে ৮/৯ হাজার বছর আগে এবং পলিমাটিদ্বারা গঠিত বিক্রমপুরের সৃষ্টি হযেছে ৫ থেকে ৩ হাজার বছর আগে। আর পলিমাটিদ্বারা এই ভূগঠন প্রক্রিয়া ধাবিত হয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে (^ সুত্র ২)।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা উপলব্ধী করতে পারি যে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ, মধুপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও পার্বত্য ত্রিপুরা ব্যতীত অন্যান্য ভূভাগের গড় বয়স ৫ হাজার বছর।


মানুষের উদ্ভবঃ বিজ্ঞানীরা মনে করেন মানবজাতি সর্ব প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশে। সেখানে একটি শাখাচারি বানরসদৃশ্য প্রাণী স্থলের খাদ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরিণত হয় ভূমিবাসীতে। তারপর বহুযুগের বিবর্তনের ধারায় এরা লাভ করে মানুষের বর্তমান আকৃতি। এ ধারায় প্রায ২০ লক্ষ বছর আগে হোমো বা মুনূষ্য, ৮ লক্ষ বছর আগে আবির্ভূত হয় দুপায়ে ভর দেযা হোমো ইরেক্টাস। এরা দুপায়ে ভর দিয়ে চলা ছাড়াও আগুনের বহুল ব্যবহার, খাবার তৈরীতে সক্ষম ছিল। প্রায ২ লক্ষ বছর আগে আবির্ভূত হয় হোমো সেপিয়ানদের এবং এদেরকেই বিবেচনা করা হয মানবজাতির পূর্বপুরুষরূপে।


অস্ট্রালয়েড বা অষ্ট্রিক ভাষীজাতিঃ উপমহাদেশে মানবজাতির আগমণের পঞ্জিকায় উল্লেখ করা হয় যে ৬০ হাজার বছর আগের সময় অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ৬০ হাজার বছর আগে পিগমী জাতীয় অত্যন্ত খর্বাকায়, কালোবর্ণ, পশমী চুল ও বিরল গাত্রলোম বিশিষ্ট এক নর গোষ্ঠি উপমহাদেশের বনাঞ্চলে বাস করত। এরা জন হিসাবে হারিযে গেলেও ভারতীয় শোনিতে এদের অবদান একেবারে উপেক্ষিত নয়। অনেকে এদেরকে আন্দামান, সিংহলে নিগ্রোবটুদের গোত্রীয় বলে মনে করেন। নীহাররঞ্জন রাযের মতে ''বাঙলার পশ্চিম প্রান্তে রাজমহল পাহাড়ের বাগদীদের মধ্যে, সুন্দরবনের মৎস্যশিকারী নিম্নবর্ণের লোকজনের মধ্যে, মৈমনসিংহ ও নিম্নবঙ্গের কোনও কোনও স্থানে ক্বচিৎ কখনও, বিশেষভাবে সমাজের নিুতম স্তরের লোকদের ভিতর, যশোহর জেলার বাশফোড়দের মধ্যে মাঝে মাঝে কৃষ্ণাভ ঘনশ্যামবর্ণ, প্রায় উর্ণাবৎ কেশ, পুরু উল্টানো ঠোট, খর্বকায়, অতি চ্যাপ্টা নাকের লোক দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা তো নিগ্রোবটু রক্তেরই ফল বলিয়া মনে হয (সুত্রঃ ^ ৩)।” সুতরাং বলা যায় যে মানবজাতির বিকাশ পর্বে উপমহাদেশ বা বাংলাদেশ জনশূণ্য ছিল না। বাংলাদেশে তথা উপমহাদেশে আদি পর্যায়ে কৃষ্ণবর্ণ, খাটো, ভেড়ার পশমের মত চুল বিশিষ্ট একটি অজ্ঞাত অরণ্যচারী নরগোষ্টির অস্থিত্ব ছিল। প্রখ্যাত জার্মান নরতত্ববিদ ফন আইকস্টেডট উপমহাদেশে নিগ্রোবটু বা তাদের কোন শাখা আদিবাসী হিসাবে স্বীকার না করলেও অস্ট্রালয়েডদের আগমণের পূর্বে নিগ্রোবটুদের দেহগড়ন ও বর্ণের মতোই উপমহাদেশে একটি অজ্ঞাত নরগোষ্টির বসবাস করার বিষয় নাকচ করেন নি। যাহোক এই অজ্ঞাত নরগোষ্ঠির বিচরণ কালে প্রায ৬০,০০০ বছর আগে (মতান্তরে এক লক্ষ বৎসর পুর্বে) আফ্রিকা মহাদেশ থেকে যাযাবর ও শিকারী শ্রেণীর মানুষ লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগর অতিক্রম করে উপমহাদেশে আগমণ করে। এরা ক্রমাগত উপকূল ইত্যাদি পথ বেয়ে দক্ষিণ পুর্ব এশিয়া সহ অস্ট্রেলিযা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এদেরকে অস্ট্রালয়েড হিসাবে বিবেচনা করা হয। অস্ট্রালয়েডরা দীর্ঘমুন্ডু, চ্যাপটা নাখ, খর্বকায়, কালো গাত্রবর্ণ বৈশিষ্টের অধিকারী ছিল। তাদের চুল ছিল ক্ষেত্রভেদে বিভিন্ন রকম। রশির মতো পাকানো, ঢেউ জাগানো, এমনকী সোজা চুলও তাদের মধ্যে ছিল। মেলানিয়শানদের ক্ষেত্রে সোজা চুলের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। এরা ক্রমে দক্ষিণ ভারত, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও ওসেনিয়ায় বসতি স্থাপন করে। অনেকে মনে করেন এরাই উপমহাদেশে প্রথম সভ্যতা স্থাপন করে। বসতি স্থাপনের পর এরা চাষাবাদ ও গুড় তৈরীর প্রণালী সর্ব প্রথম আয়ত্ব করে। অস্ট্রালয়েডরা দীর্ঘদিন ভারতের প্রথম বসতি স্থাপনকারী হিসাবে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। অস্ট্রালয়েডরা কাউকে বিতাড়িত করে নিজেদের বসতি স্থাপন করেনি। বরং দুর্গম স্থানগুলোকে সুগম, পতিত জায়গাসমূহ আবাদ করে উর্বর জমিতে পরিণত করে এবং বনের পশুকে পোষ মানিয়ে মানবকল্যানে নিয়োজিত করে। উপমহাদেশে ধান চাষের প্রচলন অস্ট্রালয়েডরাই করে থাকে। দ্রাবিড় জাতি যখন আর্যদের হাতে নিগৃহিত হয়ে অস্ট্রালয়েড উপজাতি সমূহের বাসস্থানে আশ্রয় নেয়, তখন তাদের মধ্যে তেমন কোন অসম্প্রীতির বিবরণ পাওয়া যায়না। অস্ট্রালয়েড নরগোষ্ঠিভুক্ত উপজাতিসমূহ উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। অস্ট্রালয়েডরা ভাষার ব্যবহার জানত। তাদের ভাষা বিশেষত মুন্ডাদের ভাষার প্রভাব উপমহাদেশে অত্যন্ত প্রবল ছিল। Burrow এর মতে অস্ট্রালয়েড নরগোষ্টির অনেক পরে উপমহাদেশে আগত আর্যজাতির সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ঋগবেদে প্রায় ৫০০ শব্দ প্রাচীন মুন্ডাভাষা থেকে নেয়া হয়েছে। Witzel মতে ঋগবেদের প্রাচীন অংশে প্যারা মুন্ডা এবং শেষাংশে দ্রাবিড় ভাষার প্রভাব বিদ্যমান আছে। এথেকে প্রতীয়মান হয় যে পাঞ্জাবে ঋগবেদ রচনাকালের পূর্বে অস্ট্রিক জাতির নিবাস ছিল এবং পরবর্তীতে সেখানে দ্রাবিড়দের অবির্ভাব ঘটে। দ্রাবিড়দের পরাক্রমের সময়ও মুন্ডা ভাষার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। অস্ট্রিক উপজাতিসমূহের মধ্যে এখনো তাদের আদি ভাষা টিকে আছে। বাংলাদেশের কোল, ভীল, মুন্ডা, সাওতাল প্রভৃতি উপজাতি অস্ট্রালয়েড নরগোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত। অনেকের মতে এই সব অস্ট্রালযেডরাই বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা। বাংলা ভাষার মধ্যেও অস্ট্রিক ভাষার প্রভাব অনেকখানি। বাঙ্গালী জাতির অনেকেরই মধ্যে অস্ট্রিক নরগোষ্ঠির প্রধান প্রধান দৈহিক বৈশিষ্ঠ বর্তমান আছে।


অস্ট্রিকরা সেই প্রস্তর যুগ থেকে উপমহাদেশের বাসিন্দা এবং ঐ সময়ে বাংলাদেশে বিস্তীর্ণ ভূভাগ জাগ্রত। আর অস্ট্রালয়েডরা উপমহাদেশের পশ্চিম থেকে আসামের পাহাড়ি অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশে আদিবাসী হিসাবে প্রাথমিক হিসাবে অস্ট্রালয়েডদেরকে বিবেচনায় আনতেই হয়।


প্রস্তর যুগের উত্তরকালে অস্ট্রিক জাতির ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র দেশীয় গাছ গাছালী দ্বারা তৈরী হত। অস্ট্রিক জাতি ছিল কৃষিজীবি। তাই তারা গড়ে নি কোন নগর সভ্যতা। বাংলাদেশের যে গ্রামীণ সভ্যতা তা অষ্ট্রিকদেরই অবদান। দ্রাবিড় ও আর্যদের আগমেণর পূর্ব পর্যন্ত তারা ব্রৌঞ্জ বা তামার ব্যবহার জানত না। সেজন্য অস্ট্রিক জাতির কোন সভ্যতার বস্তগত প্রমাণ পাওয়া যায়না, সংস্কৃতি ও ভাষার মধ্যেই অস্ট্রিক জাতিকে স্পষ্টরূপে পাওয়া যায়।


সুত্র নির্দেশিকাঃ
^ ১. মর্গান, জে,পি ও অন্যান্য কোয়ার্টার্নারি জিওলজি অব বেঙ্গল বেসিন, লুসিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫
^ ২. সেন, পি,কে ও অন্যান্য, প্যালাওনভিরনমেন্ট অব বেঙ্গল বেসিন ডিউরিং দ্য হলসিন পিরিয়ড, জিওরেভ, ভারত, ১৯৮৮
^ ৩. রায়, নীহাররঞ্জন; বাঙালীর ইতিহাস আদি পর্ব, দে'জ পাবলিশিং , ৫ম সংস্করণ, ১৪১২ বঙ্গাব্দ


Link: http://www.somewhereinblog.net/blog/elaheebd/29106716

0 Comments:

Post a Comment