লাউয়া ছড়া ইকো পার্কের কথা কিছু দিন আগেই শুনেছিলাম... অনেক দিন ঢাকার বাইরে যাওয়া হয়না.. বন্ধুরা বসে প্লান করলাম .. এবার লাউয়া ছড়াতেই যাব.. ঢাকা - শ্রীমঙ্গল.. সোহাগের কাউন্টার.. রাতের জার্নি .. তাই সবচাইতে আরামের ব্যবস্থা নেয়া.. ভলবোর 5টা টিকেট ক্রয় তাও আবার 7দিন আগে.. আমরা 5 বন্ধু.. আমি, ইমন, তুহিন, জিয়া আর নেহাল.. সব প্রস্তুত..

প্রথম ভুলঃ
যাওয়ার 1দিন আগে ইমন বল্লো ... "দোস্ত সোহাগের বাস তো সিলেট যাবে.. শ্রীমঙ্গল যাবে না.. ওইটা আলাদা রুট".. আকাশ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম.. চারিদিকে খোজ নিলাম.. না কোন ভাবেই সিলেটের বাস শ্রীমঙ্গল যাবে না... অগত্য টিকেট পরিবর্তনে ছোটা.. পরিশেষে শ্যামলী বাসের টিকেট ক্রয়

দ্বিতীয় ভুলঃ
ভেবেছিলাম রাতের বাসে চলে যাই.. যাতে পরের দিনটা ফ্রি থাকে.. ঘুরে কাটাতো পারি.. 11:45 এ বাস স্টার্ট করলো.. মাঝে একটা স্টপেজে কিছু পানাহার.. একটু আড্ডা.. একটু বিড়ি ফুকাফুকি.. অন্য বাসের সুন্দরীদের দিকে আড় চোখে তাকানো... বিরক্তিকর ঘোষনায় আবার বাসে ফেরত... রাত যখন ঠিক 3টা তখন আমাদের বাসের সুপারভাইজার এসে বল্লো শ্রীমঙ্গল চলে এসেছে.. আপনারাই বলেন .. এত্ত রাইতে কই যাই?

বাস থেকে নেমেই একবার বিষম খেলাম। চারিদিকের সুনশান নিরবতা। প্রকৃতির কি কোন আলাদা গন্ধ আছে? সারা গায়ে পরশ বোলানো ঠান্ডা হাওয়া রাতের ক্লান্তি এক নিমিষেই বিলীন। মার্চের এই শেষের দিনগুলোতে হয়তো এইদিকে একটু ঠন্ডা থাকে। রিক্সাওয়ালাকেও দেখলাম জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায়।

রাস্তার ধারের একটা খোলা রেস্টুরেন্ট এ কিছুক্ষন বসে/শুয়ে সময় কাটিয়ে... মশার উপদ্রবে টিকতে না পেরে আবার হাটাহাটি। রাতের শ্রীমঙ্গল শহড়... নিরব নিস্তব্দ.. .. রূপোলী চাঁদের বিমোহিত আলো.. একটা ঘোর লাগা মুগ্ধতা.. .. ক্যামন এক নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসছে। সেই কৈশরের দিন গুলো চোখের সামনে। মাঝ রাতের ঢাকা অথবা ফজর নামাজের পর রিক্সা নিয়ে শহরে ঘুরা.. ..

পর্যবাসিত জটিল জীবন.. হাপিয়ে ওঠা যান্ত্রিকতা। দুটো দিন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়া.. ..। রাতের আধার ধীরে ধীরে পাতিতারি গুটানোর চেষ্টা.. বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছুক্ষন হাটা হাটি .. শ্যামা ঘোষের মিস্টান্ন ভান্ডার খোলা পেলাম রাত্রির এই শেষ ভাগে। খুউব আয়েশ করে ধুমায়িত চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দেয়া সেই সাথে ধুম্রশলাকায় চুম্বন। এই সুখ বেশীক্ষন স্থায়ী হলোনা। ইতিমধ্যে জিয়া 2টার রিক্সার ব্যাবস্থা করে ফেলায় গেষ্ট হাউজের উদ্দেশ্যে ছুটলাম .. যদি একটু ঘুমিয়ে নেয়া যায়..

দুইপাশে সবুজ রঙের চাদর বেছানো। চায়ের বাগানের মাঝ দিয়ে আমরা ছুটছি পরিবেশ বান্ধব রিক্সায়। বিটিআরআই'র গেষ্ট হাউস ঢাকা থেকেই বুকিং দেয়া ছিলো। শহর থেকে একটু বাইরে গেষ্ট হাউস। সামনেই বাহারী ফুলের বাগান। ছিমছাম আর চমৎকার ভাবে গোছানো পুরো গেস্ট হাউসটি। আমাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষ গুলোতো যার যার ব্যাগ-বগেজ রেখে ফ্রেস হয়ে এসিটা সুপার কুল এ দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। একটু ঘুম দেয়ার অপচেষ্টা। সকালে নাস্তা পর্ব এখানেই ব্যবস্থার জন্য বলা হলো। সকালের সোনালী রোদে বারান্দায় বসেই নাস্তা সেরে.. চা বাগানের আহরিত পাতা থেকে তৈরীকৃত চায়ের কাপে ঠোট ছোয়ানো। সাথে সেই ধুম্রশলাকায় যথারীতি অগি্ন সংযোগ.. আহা.. জীবনটা যদি এভাবেই পার করে দেয়া যেত? কতই না সুখের হতো..

আড্ডার ফাকেই তুহিন মোবাইল ফোনের ক্যারিশমায় মাইক্রোবাস এর ব্যবস্থা করে ফেললো.. মজার একটা বিষয়ও জানা হলো.. এখানে নাকি মাইক্রোবাস কে লাইটাস বলা হয়.. সেটা যেই ব্রাণ্ড/মডেলেরই হোকনা কেন। সত্যিই কি তাই? সব্বাই প্রস্তুত লাউয়া ছড়ার উদ্দেশ্যে.. ...

15 মি. এর মধ্যেই আমরা লাউয়া ছড়া ইকো পার্কের সামনে। প্রবেশ দাড়ে স্কাউটদের সাদর সম্ভাষন.. দুপাশে বিভিন্ন প্রজাতীর গাছের সারি.. .. দাড়িয়ে আছে.. .. দেখে মনে হবে আকাশ ছোয়ার প্রতিযোগীতার সম্মিলন.. .. ইকোপার্কের অফিস কক্ষটা একটু ভেতরে.. 5 মিনিটের চমৎকার পায়েহাটার পথ.. অফিস প্রসেসিং কমপ্লিট.. শুধুমাত্র নাম লেখাতে হয় .. ভিজিটর এর হিসাব রাখার জন্য। সাথে গাইড হিসেবে রায়হান কে সঙ্গে নিলাম। ইউএসএইড এর সহায়তায় রায়হান ইকো গাইড হিসেবে ট্রেইনিং পেয়েছে। ছোট্ট একটা ছেলে। ইন্টারমিডিয়েট এ লেখাপড়া করা অবস্থায় ওর ফ্রি টাইমগুলোতে ইকো গাইড হিসেবে কাজ করে। (সেল # 01718382179)। সবচাইতে বড় ট্রেইলটা আমরা ঘুড়ে দেখার জন্য বেছে নিলাম।

ইকো গাইড রায়হানের সাথে হাটতে হাটতে কথা বলছিলাম.. জানালো ভোর 5/6টায় ইকো পার্কে পৌছতে পারলে .. .. ঝাকে ঝাকে পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে ওই সময়। কপাল ভালো থাকলে 2/1টা হরিন ও দেখা যেতে পারে.. রায়হান 2বার দেখেছে। হাটতে হাটতে রায়হানের লাইফের এইম সম্পর্কে জানা হলো .. লন্ডন যাওয়ার অপেক্ষায় .. সেইখানে ওর মামা আছে.. একটা সময় পড়ে ও চলে যাবে.. আচ্ছা বলেন তো তাহলে একসময় সিলেট কারা থাকবে?

কিছুদুর আসতেই রায়হান সব্বাইকে থামতে বল্লো.. মুখে আঙ্গুল দিয়ে ইশশশশ .. সব্বাই চুপ.. বাতাসের এক নাগারে শন শন শব্দ.. রায়হানের দৃষ্টি খুজে খেয়াল করলাম.. দুর দিয়ে অনেক গুলো সাদা বানর আড্ডা দিতেছে.. .. মনে হয় মিস করতেছে ব্লগ এর কাউকে কাউকে.. .. জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পা টিপে টিপে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম.. .. ব্যার্থ.. আবার পথ চলা অনেক দিন পর এই প্রথম মাটির সোদা গন্ধ পেলাম .. অদ্ভুত এই গন্ধটা আমায় মোহিত করে..

রায়হান আবার থামালো কাঠবেড়ালী দেখার জন্য.. অনেক কষ্টে বেচাড়াকে খুজে পেলাম.. এর মাঝেই 2খান শিম্পাঞ্জিও দেখা গেল.. নেহাল সেল ফোন বের করে দেখে নেটওয়ার্ক নেই.. ওর নাকি বউ এর সাথে শিম্পাঞ্জির কথা বলিয়ে দেয়ার কথা ছিলো.. বেচারার ব্যাড লাক খারাপ..

চারিদিকে সবুজের সমারোহ.. বাতাসের শন শন শব্দ.. ঝাড়া পাতার গালিচা বেছানো পথে আমাদের পথচলায় মুড় মুড় সঙ্গিতের ধ্বনি .. সবুজের মাঝে আমরা হাটছি তো হাটছি.. বনের ভেতর এই প্রথম যাওয়া.. একটা এডভেঞ্চার.. আড্ডাবাজির মাঝে হেটেই চলেছি.. কখনো একটু জিরিয়ে নিচ্ছি .. আবার হাটা শুরু.. মাঝে মাঝে বাশ ঝাড় পরছে .. কিছু আদিবাসি বাশ কেটে মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে অনুমতি সাপেক্ষে.. পথের শেষ দিকে এসে একটা বাশের একটা মাচা পেলাম.. ওইখানে একটু জিড়িয়ে আবার হাটা.. এবার সত্যি আমাদের ক্লান্তিতে পেয়ে বসেছে.. টানা 3 ঘন্টা হেটে ফেলেছি .. আরো 30 মিনিট এর পথ বাকি.. .. বনের এইখানটায় কিঞ্চিৎ নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল.. নেহাল আর তুহিন এই সময় বউকে পার্কের আপডেট জানিয়ে.. আবার শুরু হলো ফিনিশিং টাচ..

পাক্কা সাড়ে তিন ঘন্টায় শেষ হলো আমাদের ওয়াক এওয়ে.. জট্টিল হাটা হইলো.. আমরা ইকোপার্কের যেই ট্রেইল ধরে হেটে শেষ মাথায় পৌছলাম সেটা হলো ফুলবাড়িয়া.. এখানে এক ফরেষ্ট অফিসার এর বাসায় পনি পান শেষে বাস এ করে লাওয়া ছড়া ইকো পার্কের মেইন গেইট এ পৌছলাম.. ওইখানে আমাদের লাইটাস অবস্থান করছিলো। গাড়ি ছাড়ার আগে 2জন অপূর্ব সুন্দরী ললনাকে পার্কে প্রবেশ করতে দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল.. আমরা চলে যাচ্ছি আর তাহারা মাত্রই প্রবেশ করিতেছে.. যত্তোসব...

দুপুরের লাঞ্চ শহরের একটা রেস্টুরেন্টে সেরে আবার ছুটরাম মাধবপুর লেক এর উদ্দেশ্যে। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এই নয়নাভিরাম এই লেক। বিকেলে রোদে রুপোলী স্রোত চক চক করছিলো.. গ্রীস্মের পাগল করা বাতাসে দিনের সমস্ত ক্লান্তি এক নিমিষেই বিলীন.. প্রস্তুতি নিয়ে আসার কারনেই লেকে গোসলে নেমে গেলাম.. অনেক দিন পর সাতার কাটলাম .. ডুবাডুবি শেষে ম্যারাথন আড্ডা.. হৈ-চৈ..

সন্ধ্যায় শহরে ফিরলাম ফিরতি বাসের টিকেটের জন্য। টিকেট শেষে দেখতে গেলাম ষিতিশ বাবুর প্রাইভেট চিড়িয়াখানা। খুউবি ছোট্ট পরিসরের এই চিড়িয়াখানা ভালোই লাগলো। এখানে রাখা আছে বিড়ল প্রজাতীর সাদা বাঘ। আরো আছে হরিন, বানর (4 প্রজাতির, বিড়ল প্রজাতীর লাজুক বানর ও এখানে সংগৃহীত), 2টা ভাল্লুক, ডাহুক, টিয়া, ময়না, একটা বড় অজগর সাপ

রমেশ বাবুর বিশ্ব বিখ্যাত নিল কণ্ঠি চা খেতে গেলাম সন্ধার পর। এই চা এর বৈশিষ্ট হলো 5টি লেয়ার (রঙের)। প্রতি কাপ চা 50 টাকা। 4 রঙের চা এর দাম 40, 3 রঙের চা এর দাম 30, 2 রঙের চায়ের দাম 20 আর স্পেশাল চা 10 টাকা। এছাড়াও সর্বন্মি চা এর দাম 5টাকা কাপ এখানে।

অর্ডার দিয়ে যথারীতি বসলাম। রমেশ বাবু যেই ঘরে এই বিখ্যাত চা তৈরী করেন.. সেখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত .. কাউকেই সেখানে সে এলাউ করেন না। চা এর দোকেনে বিশাল আয়োজন মানুষ জনের বাসার জন্য। বড় একটা ঘড় ছাড়াও সামনে খোলা বড় একটা যায়গা নিয়ে চেয়ার বিছানো। পাশেই কার পার্কিং। অনেক গাড়ির ভিড় লক্ষনীয়। রমেশ বাবু মুক্তা গাছার বাসিন্দা ছিলেন। পরে মাইগ্রেন্ট হয়ে এখন শ্রীঙ্গলে। শোনা যায় বৃটিশ সরকার কোটি টাকার বিনিময়ে তার এই চা এর ফর্মুলা কিনতে চেয়েছিলো। কিন্তু রমেশ বাবু হাত ছাড়া করতে রাজী হয়নি। তাকে লণ্ডন গিয়ে এই চা বানাতেও নাকি প্রস্তাব দিয়েছিলো। এই দেশ ছেড়ে কোথাও যাওয়ার তার ইচ্ছা নেই। ভালো লাগলো রমেশ বাবুর দেশ প্রেম দেখে।

রাতে গেষ্ট হাউজে ফিরে যেটা সবচাইতে মন খারাপ করলো .. তা হলো গেষ্ট হাউজে কোন টিভি নেই। ওইদিন ছিল বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়ার খেলা। অনেক রাত পর্যন্ত বাসায় ফোন করে খেলার খবর জানার চেষ্টা করে একটা কষ্ট নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।

0 Comments:

Post a Comment



বস্তাবন্দি

Powered By Blogger
Subscribe to Feed